মেট্রো শব্দটি ‘প্যারিস মেট্রোপলিটান’-এর একটি সংক্ষিপ্ত নাম যা দ্রুতই মেট্রোতে রূপান্তরিত হয়। এটাকে দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম বলা হয়। ৫৫টি দেশে ১৬৮টি মেট্রো সিস্টেম তালিকাভুক্ত আছে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রাজধানীতে মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট নামে পরিচিত। ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। যার অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়।
পৃথিবীতে মেট্রো সিস্টেমের উৎস, উৎপত্তি ও ইতিহাস
ওয়ার্ল্ডের প্রথম শহুরে ভূগর্ভস্থ রেলওয়ে হলো মেট্রোপলিটান রেলওয়ে, যা ১৮৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডনে মেট্রোপলিটন রেলওয়ে খোলার মাধ্যমে দ্রুত ট্রানজিটের ইতিহাস শুরু হয়। ওই সময় প্যাডিংটন থেকে ফারিংডন পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার বিশেষ রেলপথ খুলে দেওয়া হয় জনগণের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। প্রথমদিনেই চলাচল করে ৩৮ হাজার যাত্রী। আর প্রথম বছরে যাতায়াত করে ৯৫ লাখ। দ্বিতীয় বছর সে সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ২০ লাখে। এখান থেকেই শুরু মেট্রোরেলের রূপকথার।
নর্স পুরাণে উল্লেখিত থরের রথটা যেন বাস্তবেই তৈরি করে ফেলেছে মানুষ। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। লন্ডনের চৌহদ্দি ছাপিয়ে বাতাসের বেগে মেট্রোরেল ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে।
ইউরোপ শিল্প বিপ্লবের পর রূপকথার মতো সমৃদ্ধি অর্জন করে। বিশেষ করে আয়তন ও জনসংখ্যায় অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে ওঠে লন্ডন। নগরীর রাস্তাগুলোয় ক্রমেই বেড়ে উঠতে থাকে যানজট। প্রতিদিন ভিড় লেগে থাকত গাড়ি ও ট্রেনে। ১৮৫০ সাল নাগাদ অন্তত সাতটি রেললাইন প্রতিষ্ঠার পরও বর্ধমান চাপ সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। নতুন রেলপথ স্থাপনেও নারাজ কর্তৃপক্ষ। বিকল্প হিসেবে আন্ডারগ্রাউন্ড রেল যোগাযোগের ধারণা নিয়ে হাজির হন চার্লস পিয়ারসন। বিল পাস হয় ১৮৫২ সালে।
ঠিক পরের বছর রেলওয়ে কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা একটা বৈঠক করে ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত করেন জন ফাউলারকে। টানাপড়েনের পর সংসদ থেকেও পাওয়া যায় অনুমতি। নর্থ মেট্রোপলিটন রেলওয়ে অ্যাক্টের অধীনে ১৮৫৪ সালের ৭ আগস্ট জন্ম নেয় মেট্রোপলিটন রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ। ১৮৬২ সালে শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত খরচ পড়েছে ১৩ লাখ পাউন্ড। পরিচালনা পর্ষদের নজরদারি ও নিরাপত্তাবিষয়ক সতর্কতা শেষে ১০ জানুয়ারি পরিবহনের উপযুক্ত ঘোষণা করা হয় মেট্রোরেলকে। অবশ্য যার মস্তিষ্কপ্রসূত এ আয়োজন, সেই চার্লস পিয়ারসন দেখে যেতে পারেননি। ঠিক আগের বছর সেপ্টেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন মেট্রোরেলের স্বপ্নদ্রষ্টা।
লন্ডনের সফলতার গল্প অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে নেওয়া হয় নতুন উদ্যোগ ‘দ্য মেট্রোপলিটন রেলওয়ে অব কনস্টান্টিনোপল টু গালাট পেরা’। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে এর কাজ শেষ হয়। যাত্রী পরিবহন শুরু করে ১৮৭৫ সালের ১৭ জানুয়ারি। আটলান্টিকের অন্য পাশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছে যায় জয়রথ। ১৮৯৭ সালে বোস্টনে নির্মিত সাবওয়ে টানেল এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো মেট্রো প্রকল্প এটি। এর সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে যাত্রা করেছে আধুনিকতার সাবওয়ে লাইন। বিশেষ করে নিউইয়র্ক শহরে নয় মাইল বিস্তার নিয়ে রয়েছে চার ট্র্যাকের লাইন।
দক্ষিণ গোলার্ধে সবচেয়ে পুরোনো সাবওয়ে অবস্থিত আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে। ১৯১৩ সালে নির্মিত সাবওয়েটি প্রতিদিন ১ লাখ ৯০ হাজার যাত্রী পরিবহন করে। এর ঠিক পাঁচ বছর পরে ১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর চালু হয় মাদ্রিদ মেট্রো। পৃথিবীর দীর্ঘতম মেট্রোগুলোর একটি এটি। স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফানসো নিজে তত্ত্বাবধান করেন প্রকল্পটি। ১৯২৪ সালে চালু হয় বার্সেলোনা মেট্রো। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ আধুনিকায়নের বাতাস আমেরিকা ও ইউরোপের মাটি ছেড়ে হানা দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নেও।
১৯৩৫ সালে মস্কোয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া মস্কো মেট্রো পৃথিবীর সবচেয়ে নান্দনিক মেট্রোগুলোর একটি। বিশেষ সজ্জা ও আলোকায়নের জন্য মেট্রোর স্টেশনকে ভূগর্ভস্থ স্বর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, মস্কো মেট্রোয় ৩০৮ কিলোমিটার রেলপথ ও ১৮৬টি স্টেশন। বিশ্বের ব্যস্ততম মেট্রোর তালিকায়ও রয়েছে এর নাম। ২০ শতকের পরবর্তী দিনগুলোয় চারদিকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে মেট্রোরেল। একই সঙ্গে আসতে থাকে বিবর্তন।
১৯৫৪ সালে নির্মাণ শেষ হয় টরন্টো সাবওয়ের কাজ। কানাডার দ্বিতীয় সাবওয়ে হিসেবে মন্ট্রিল মেট্রোর যাত্রা ১৯৬৬ সালে। দক্ষিণ আমেরিকার পরাশক্তি ব্রাজিল অবশ্য এদিক থেকে পিছিয়ে ছিল। মেট্রোর এ মিছিলে দেশটি যুক্ত হয় ১৯৭৪ সালে। কাছাকাছি সময়েই চিলিতে স্থাপিত হয় মেট্রো ডি সান্তিয়াগো। ৮৫টি স্টেশন ও পাঁচটি লাইন নিয়ে নির্মিত এ মেট্রো। দক্ষিণ আমেরিকায় রাবারের টায়ারযুক্ত একমাত্র মেট্রোও এটি।
আফ্রিকার দেশ হিসেবে মেট্রোয় প্রথম নাম লেখায় মিসর। ১৯৮৭ সালে কায়রোয় চালু হয় মেট্রোরেল। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে মেট্রোরেলে নাম লেখায় জাপান। ১৯২৭ সালে সাবওয়ে লাইন প্রতিষ্ঠিত হয় টোকিওতে। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৩৩ সালে ওসাকায় নির্মিত হয় দ্বিতীয় মেট্রো। এ জগতে চীনের যাত্রা দেরিতেই বলতে হবে। দেশটির প্রথম মেট্রো বেইজিং সাবওয়ে যাত্রা করে ১৯৭১ সালে। তবে খুব দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরে।
১৯৭৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি শহরেও চালু হয় যোগাযোগের এ নতুন স্রোত। ক্রমে যুক্ত হয় আরও কিছু দেশের নাম। সিঙ্গাপুরে ১৯৮৭ সালে প্রথম হেভি রেল সিস্টেম চালু হয়। তাইওয়ানে মেট্রোরেলের যাত্রা ১৯৯৬ সালে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে মেট্রো চালু হয় ১৯৯৯ সালে, আরব আমিরাতে ২০০৯ ও সৌদি আরবে ২০১১ সালে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা শহরে ২৪ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে মেট্রোরেল চালু হয়। শুরু হওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন এলাট্টুভালাপিল শ্রীধরন। এটি প্রথমে এসপেলেনডি থেকে ভবানীপুর (বর্তমান নেতাজী ভবন) মোট ৩.৪ কিলোমিটার এলাকায় ১৭টি স্টেশনে চলাচল করত। এ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে কলকাতা মেট্রোর দুটি সক্রিয় যাত্রাপথ রয়েছে, একটি দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১.৩৬৫ কিমি মেট্রোলাইন এবং অপরটি ৯.১ কিমি দীর্ঘ সল্ট-লেক সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ মেট্রোলাইন। এখানে ৩৪টি মেট্রো স্টেশন বিদ্যমান, যার মধ্যে ১৭টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ, ১৫টি স্টেশন উত্তোলিত এবং ২টি স্টেশন ভূমিগত। এ ছাড়া ২০০২ সালে সম্পূর্ণ আধুনিকতা নিয়ে চালু হয় দিল্লি মেট্রো।
মেট্রোরেলের দীর্ঘ ইতিহাস বিবর্তিতও হয়েছে নানাভাবে। যুক্ত হয়েছে নানা রকম সুবিধা। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিবর্তনে মেট্রোরেল একটা বিস্ময়কর গল্পের নাম। সেই গল্পে এবার যুক্ত হলো বাংলাদেশের নাম।
বাংলাদেশে মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
জাইকা ও ডিএমটিসিএল ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ৬টি মেট্রো লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই নেটওয়ার্কে ৫১টি এলিভেটেড স্টেশন ও ৫৩টি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রোরেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে।
২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ নামক লাইনটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে।
এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১.৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩.৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১.২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি লাইন-১ হবে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল।
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত প্রতীক্ষার অবসান হলো। স্বপ্ন এখন আর অধরা নয়, রাজধানীবাসীর হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় মেট্রোরেল। বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ প্রথমবার ঢাকার উড়াল রেললাইন দিয়ে হর্ণ বাজিয়ে ছুটল সমৃদ্ধ তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্রবাহন মেট্রোরেল। যা এতদিন উন্নত কোনো দেশের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল।
|