ভ্রমন ডেস্ক
নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা! ইস্তানবুলে আসার কয়েক মাস আগে টিকিট কেটে খোঁজ করছিলাম, এখানে যে সাত দিন থাকবো সেটা কীভাবে ভাগ করবো। বাচ্চাদের স্কুল আর কলেজ হাফ টার্মের জন্য এক সপ্তাহ ছুটি। ব্রিটেনের সব স্কুল কলেজই মোটামুটি ছয় সপ্তাহ পরপর একটা বন্ধ দেয়, এটাকে হাফ টার্ম বলে। দুটো হাফ টার্মের মাঝের বন্ধকে বলে ফুল টার্মের বন্ধ। যেহেতু এবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও যাইনি তাই অক্টোবরের হাফ টার্মের ছুটিতে কোথাও যাওয়ার প্লান এবং এভাবেই ইস্তানবুলে আসার সবকিছু ঠিক করে রাখা।
২৫ অক্টোবর শেষ ক্লাস হলো হাফ টার্মের, তাই আমাদের ফ্লাইট ছিল ২৬ অক্টোবর। ২৭ ও ২৮ অক্টোবর মূল ইস্তানবুলের অর্থাৎ প্রাচীন সময়ের কনস্টান্টিনোপলের মূল শহরের বিভিন্ন স্থান দেখার প্ল্যান রেখেছিলাম। তেমন কিছু না ভেবেই ২৯ অক্টোবরের প্ল্যানে ছিল ডলমাবাচে (তুর্কি ভাষায়) রাজপ্রাসাদে দিনের প্রথমভাগ কাটিয়ে রুমেলি হিসারি দুর্গ দেখে ফেরার পথে টাকসিম স্কয়ার হয়ে হোটেলে ফিরবো। প্ল্যানটা করার সময় একটি জিনিস মাথায় আসেনি বা খেয়াল করিনি। কাজটা অবচেতনেই করেছিলাম, এটাই হয়তো নিয়তির খেলা।
নিয়তির খেলাটা হচ্ছে, অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে কামাল আতাতুর্ক শুরু করেছিলেন প্রজাতন্ত্র। অটোম্যান সম্রাজ্যের শেষ খলিফা আব্দুল মজিদের (২) জন্ম ডলমাবাচে রাজপ্রাসাদে এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রাজ প্রথা অনুযায়ী রাজপ্রাসাদের বাইরে যাননি। তার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা সবই প্রাসাদের আঙিনায়। তার কাজিন ছিলেন সেসময় সুলতান এবং তিনি ছিলেন পরবর্তী উত্তরসুরী রাজকুমার। কাজিনের পদচ্যুতির পর সুলতানি আমলের পতন হয়। এরপর তুর্কি জাতীয় আসেম্বেলি থেকে তাকে খলিফা নির্বাচিত করা হয়।
কয়েক বছর পর খলিফা রাজত্ব শেষ হয়ে তুর্কি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানদের পরাজয়ের পর তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের নেতা ছিলেন ফিল্ড মার্শাল এবং রাজনৈতিক নেতা কামাল আতাতুর্ক। ছয় বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন আতাতুর্ক। এই ছয় বাহিনীর মধ্যে ছিল ব্রিটিশ, গ্রিস, আর্মেনিয়া, ফ্রান্স, ইতালি এবং কিছু ইউরোপিয়ান রাজপরিবার। তিনি হলেন আমাদের ভাষায় তুর্কবন্ধু; যিনি আধুনিক তুর্কির দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ডলমাবাচে রাজপ্রাসাদে ছিলেন এবং এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
৯৬ বছর আগে আজকের এই দিনে তিনি তুর্কিকে প্রজাতন্ত্র বানিয়েছিলেন এবং দিনটি তার্কিশ রিপাবলিক ডে হিসেবে পালন করা হয়। আমাদের আজকের যাত্রা শুরু হয়েছিল এ রাজপ্রাসাদ দেখে। ভেতরে ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষেধ, যদিও অনেকেই এই নিষেধ অমান্য করছিলেন। কিন্তু নিষেধ অমান্য করতে ইচ্ছে হয়নি। তাছাড়া এভাবেই বাচ্চারা শেখে কীভাবে নিষেধ অমান্য করতে হয়। তাই শুধুই কাছ থেকে দেখে অভিজ্ঞতাকে মনের ক্যামেরায় বন্দী করেছিলাম।
তুর্কির অনেকেই এবং বাংলাদেশ আর্মির একটি পরিবার (আমাদের সামনে ছিল) হঠাৎ হঠাৎ ছবি তুলছিল; যা উচিত নয়। নিষেধকে আমরা কবে নিষেধ হিসেবে মান্য করবো? প্রাসাদের ভেতরে ছিল অটোম্যান সম্রাটদের জীবন, তাদের স্মৃতি। বিবিদের (কতোগুলো বিবি ছিল কে জানে) আর মায়ের বাসস্থান, ব্যবহারের রাজকীয় জিনিসপত্র (চেয়ার, সোফা, বাথরুম, কার্পেট, কাপড়, পালঙ্ক, ঝাড়বাতি, বন্দুক, লাইটার, তলোয়ার, পেইন্টিং, যুদ্ধের কাপড়, বিভিন্ন বিখ্যাত যুদ্ধের জিনিসপত্র ইত্যাদি) আর দুর্দান্ত কারুকাজ খচিত রাজদরবার। ডলমা মানে পূরণ করা (পটলের পেটের মধ্যে কিমা কিংবা চিংড়ি ভরে পটলের দোলমা বানানো হয়, যেভাবে ঠিক সেইভাবে যেন পূরণ করা)।
বসফরাস বে’র একটি অংশকে পূরণ করে নিয়ে এ রাজপ্রাসাদ তাই হয়তো এমন নাম। রাজপ্রাসাদের প্রশাসনিক ভবন সবচেয়ে জমকালো। এরপর হেরেম যেখানে তার বিবি, মা থাকতেন সেটাও দেখলাম। এরপর ঘড়ির জাদুঘর। বিভিন্ন যুগে যেসব বিখ্যাত ঘড়ি বানানো হয়েছিল; সেসব এই জাদুঘরে রাখা আছে। অদ্ভুত সব কারিগরি দক্ষতা আর শৈল্পিক সৃষ্টি। এরপর প্রাসাদের বাইরের উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো, সেখানে ক্যাফেতে কিছু খাওয়া, ছবি তোলা আর বসফরাসের তীর ঘেঁষে প্রাসাদের উদ্যানে হেঁটে বেড়ানো। অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা ছিল এটি।
বসফরাসের তীর ঘেঁষে ছবি তোলার পর উদ্যানে সুদৃশ্য গোলাপ দেখে আমার বিবি বললেন তাকে অন্তত এমন একটি গোলাপের গাছ বানিয়ে দিলেই তিনি খুশি। শানে নজুল হচ্ছে- ইংল্যান্ডের বাড়িতে পেছনের বাগানের কয়েকটি গোলাপ গাছ লাগিয়েছি, তবু তার গোলাপের গাছে মন ভরছে না। তখন বললাম, আমি তো সুলতান আলী নই যে সুলতানের মতো এতো এতো বিবি নিয়ে ঘুরছি। তাই এতো এতো গোলাপ লাগাবো। যার একটি বিবি তার থাকবে একটি গোলাপ গাছ। এভাবে গোলাপ গাছের হিসেব বরাবর করে আমরা চলে গেলাম রুমেলি হিসারি ফোর্টরেসের দিকে।
রুমেলি হিসারির কাহিনি এ নিয়তির খেলাকে অর্থপূর্ণ করবে। কনস্টান্টিনোপল দখল করে অটোম্যান সাম্রাজ্যের শুরুটা এখানেই। ১৫ শতকের দিকে সেনা স্থাপত্যের ভেতর যুদ্ধবিগ্রহে জয়ের জন্য নানা ধরনের কৌশলগত কাঠামো করা হতো। এ সময় অটোম্যান সুলতানের নির্দেশে এ দুর্গ বানানো হয় বসফরাস প্রণালির মাথায়। কনস্টান্টিনোপলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের যে সব নৌবহর যাওয়া-আসা করতো, তা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যেত। ব্ল্যাক সী হয়ে আসা জাহাজগুলো দুর্গের দৃষ্টি এড়াতে পারতো না।
বাইজান্টাইনের কাছ থেকে অটোম্যানরা ক্ষমতা নেওয়ার পেছনে এ দুর্গের অবদান সবচেয়ে বেশি। যেসব জাহাজ সৈন্য, গোলাবারুদ, অস্ত্র এসব নিয়ে যেতো; সেসবের পথ এখান থেকে আটকে দেওয়া হতো। অটোম্যানরা অনেক বছর ধরেই বাইজান্টাইনদের কাছ থেকে ক্ষমতা দখলের পায়তারা করেছে কিন্তু সফল হয়নি কখনোই। কারণ কনস্টান্টিনোপলের চারিদিকে বাইজান্টাইনরা যে উঁচু আর মজবুত দেয়াল তুলেছিল, তা ভেদ করে কনস্টান্টিনোপল প্রবেশ করা কোনো সেনাদলের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
চতুর্থ ক্রুসেড এবং প্লেগের পর থেকে বাইজান্টাইনরা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক মন্দায় ভাসছিল। কোনভাবেই তারা এ মন্দা দূর করতে পারছিল না। ক্রমে তারা হয়ে পড়ছিল দুর্বল। সেসময় অটোম্যানরা বলকান এবং এশিয়া মাইনর সম্প্রসারিত করেই যাচ্ছে। সুলতান মেহমেদ-২ সেসময় ব্রোঞ্জের কামান (তোপ) বিক্রির চেষ্টা করেছিল বাইজান্টাইনদের কাছে। কিন্তু অর্থাবস্থা ভালো না থাকায় তারা এই সুপারগান কিনতে পারেনি।
মেহমেদ তখন অভিনব এক পরিকল্পনা করেন। যেহেতু অটোম্যান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ করতে হবে এবং কনস্টান্টিনোপল দখল করাটা অনেকটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কারণ এর আগের সুলতানরা এ কাজে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি তখন এ দুর্গ তৈরির নির্দেশ দেন। এখান থেকেই সুপারগান (ব্রোঞ্জের শক্তিশালী কামান) চালিয়ে বাইজান্টাইন দেয়াল গুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেকখানি। এদিকে সব নৌবহর আর সেনা, অস্ত্র ইত্যাদি আটকে দেন; অন্যদিকে কামানের গোলার গুড়ুম। ব্যাস! কেল্লাফতে হয়ে গেল। মেহমেদের হাতেই হাজার বছরের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হলো।
এ কারণে রুমেলি হিসারি অটোম্যান সম্রাজ্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দুর্গ। এখানে তিনটি বিশাল বুরুজ আছে, যার দুটো থেকে কামান দাগানো হয়েছিল কনস্টান্টিনোপলের দিকে আর অন্যটি থেকে নৌবহর আর জাহাজ আটকে দেওয়ার জন্য কামান দাগানো হয়েছিল। এর চতুর্দিকের উঁচু দেয়ালের সাথে মোট ১৩টি পাহারা দেওয়ার বুরুজ বানানো হয়েছিল। বসফরাসের দিকে যে বুরুজ সেটি ১২ দিক বিশিষ্ট বহুভুজী বুরুজ, ৯ তলার সমান। এর নাম হালিল পাশা বুরুজ। তিনটি বুরুজের ব্যাসই ৭৬ ফুট। প্রতিটি বুরুজেরই আলাদা বিশাল তোরণ এবং বিভিন্ন দিকে গুপ্ত ফটক ছিল। যা খাবার এবং সেনাদের অন্যান্য জিনিসপত্র আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। এর কারণ ছিল, যদি কোনোভাবে মূল তোরণে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সেটা বন্ধ করে এ গুপ্ত ফটকের সাহায্যে এসব পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায়।
কী অদ্ভুত তাদের বুদ্ধি আর যুদ্ধ কৌশল। মূল শক্তিশালী কামানে বাইজান্টাইনদের শক্তিশালী দেয়াল পুরোপুরি গুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ সেটার গতি এতো কম ছিল যে, দেয়ালে আঘাত করতে করতে তা শক্তি হারিয়ে ফেলত। কিন্তু অটোম্যানরা এ জন্য তাদের দখল করা জাহাজ দিয়ে চতুর্দিক থেকে কনস্টান্টিনোপল ঘিরে ফেলে। জাহাজগুলো দেয়ালের খুব কাছে নিয়ে যেয়ে কামান দাগানো হয়। আজও দেয়ালের ভাঙা অংশ দেখা যায়। ইস্তানবুল থেকে যদি ট্যাক্সি নিয়ে ইয়েদিকুলা যাওয়া যায়। ইয়েদিকুলাতেই দেয়ালের গেট ছিল। বসফরাসের দিকে মুখ করে বানানো হয়েছিল। এভাবেই দুর্গের সাহায্যে হাজার বছরের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন আর অটোম্যান সাম্রাজ্যের শুরু।
এতো বছর পরে এসে আজ এখানে সুনসান নীরবতা। দুর্গে ঢুকতে হলে আরও দুর্গম পথে ট্যাক্সি করে আসতে হয়। বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় যখন ট্যাক্সি চিকন আর পাহাড়ি দুর্গম পথ ধরে নামে। দুর্গের ঠিক মাঝখানে সৈন্যদের বিনোদনের জন্য উন্মুক্ত থিয়েটার। দেখতে অনেকটা গ্যাল্যারির মতো করে বানানো হয়েছিল। এক থেকে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না পুরো দুর্গ ঘুরে দেখতে। অনেক উঁচুতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া যায়।
ভাবতে অবাক লাগে, সেই হাজার বছর আগে কীভাবে মানুষ এইসব ভয়ঙ্কর দুর্গ বানাতো। কী বিশাল সুউচ্চ সব বুরুজ আর গুপ্ত পথ, সেটি আটকে রাখার অভিনব কৌশল। শিহরিত হয়ে গেলাম ইতিহাস ছুঁয়ে। আমাদের ভ্রমণ শেষে বসেছিলাম দুর্গের উঁচু চাতালে, একদম ছিমছাম। শুধু পাখির আওয়াজ, সামনে নীল বসফরাসে বয়ে চলা জাহাজ আর নাবিকদের বাজানো হর্ন। অটোম্যানরা এ দুর্গের মাঝে একটি মসজিদও বানিয়েছিল। সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে সেখানে ওজু করে নামাজ পড়লাম আমরা কয়েকজন ট্যুরিস্ট, ছেলে-মেয়ে সবাই। তারপর নিচে নেমে অনেকক্ষণ বসেছিলাম বসফরাসের নীল পানির খুব কাছে।
একদিকে নতুন প্রজাতন্ত্রের আধুনিক ইস্তানবুলের আধুনিক সেতু, অন্যদিকে প্রাচীন দুর্গম দুর্গ আর মাঝে নীল পানির বসফরাস, তার তীরে আমরা কয়েকজন বসে। কিছু ছবি স্মৃতি করে নিয়ে এলাম কিন্তু অভিজ্ঞতাকে ক্যামেরায় বন্দী করা যায় না। সেটা গেঁথে নিলাম হৃদয়ে। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে দুর্গম পথ দিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, নিয়তির কী অদ্ভুত এক খেলা! যে দুর্গের মাধ্যমে অটোম্যানরা কেড়ে নিলো বাইজান্টাইনদের কাছ থেকে হাজার বছর আঁকড়ে রাখা ক্ষমতা। যে অটোম্যানদের সুলতানি আর খলিফা সাম্রাজ্যের পতন হয়ে শেষ খলিফা চলে গেলেন যে রাজপ্রাসাদ হয়ে। আর যেদিন এ ঘটনা ঘটলো অর্থাৎ কনস্টান্টিনোপল থেকে হলো ইস্তানবুল- আমরা অদ্ভুতভাবে ঠিক সেদিনই এ দুইটা ঘুরে দেখলাম। উপভোগ করলাম দুর্গ আর প্রাসাদের মাঝের একমাত্র নীরব সাক্ষী- নীল পানির বসফরাস প্রণালি। যেখানে আজ ছুঁয়ে আছে প্রশান্তি আর স্বাধীনতা। প্রাচীন কনস্টান্টিনোপলের ইতিহাস ছুঁয়ে উপভোগ করলাম নতুন ইস্তানবুলকে।